Connect with us

Entertainment

ইউটিউব থেকে কোটি ডলারের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে ১০ বছর বয়সী কাজী

Published

on

মাত্র ১০ বছর বয়সের রায়ান কাজীর খেলনার ভিডিও ইন্টারনেটে ঘুরে বেড়াচ্ছে ২০১৫ সাল থেকে। ১০টি চ্যানেলের সম্মেলনে গঠিত ‘রায়ানস ওয়ার্ল্ড’ গতবছর দুই হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্র্যান্ডেড পণ্যদ্রব্য বিক্রি করেছে। এসব ভিডিও থেকে বছরে ২০০ কোটি টাকার চেয়েও বেশি আয় করে থাকে কাজী পরিবার। 

যাদের বাসায় ছোট শিশু আছে, এবং যারা স্মার্টফোনে ভিডিও ছেড়ে দিয়ে বাচ্চাদের সামলান, তারা হয়তো চিনে থাকবেন এই ছেলেকে। বিশেষ করে আপনার শিশুর যদি খেলনার ভিডিও দেখার অভ্যাস থাকে। 

রায়ান কাজীর খেলনার ভিডিও ইন্টারনেটে ঘুরে বেড়াচ্ছে ২০১৫ সাল থেকে। বর্তমানে অ্যামাজন, ওয়ালমার্ট, নিকেলোডিয়ন, স্কেচার্সের মতো বেশ কিছু বড় বড় কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়া রায়ানের ১০টি ভিন্ন ভিন্ন চ্যানেল আছে ইউটিউবে। এই ১০ চ্যানেলের সম্মেলনে গঠিত ‘রায়ানস ওয়ার্ল্ড’ (রায়ানের জগত) গতবছর দুই হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্র্যান্ডেড পণ্যদ্রব্য বিক্রি করেছে। এসব ভিডিও থেকে বছরে ২০০ কোটি টাকার চেয়েও বেশি আয় করে থাকে কাজী পরিবার। 

ডিমের ভিডিও থেকে উত্থান 

টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক করার সময় পরিচিত হন রায়ানের বাবা-মা, শিওন ও লোন কাজী। প্রযুক্তিবিদ বাবার ছেলে শিওন হাইস্কুলে পড়ার সময় জাপান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পারি জমান। লোনের মার্কিন মুল্লুকে পা দেওয়ার ইতিহাস আবার এতো সুখকর না। 
 
লোনের পরিবার নৌকায় করে তাদের মাতৃভূমি ভিয়েতনাম থেকে পালিয়েছিল। সেখান থেকে কয়েক বছর মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের শরণার্থী শিবিরে ঘুরে বেড়ানোর পর যুক্তরাষ্ট্রে জায়গা হয় তাদের।

অনার্স শেষ করে মাস্টার্সের উদ্দেশ্যে যখন টেক্সাস ছেড়ে নিউ ইয়র্কে পাড়ি জমান শিওন, তখন ভূমিষ্ঠ হয় রায়ান। তাই মাস্টার্স না করেই টেক্সাসে রায়ান ও লোনের কাছে ফিরে আসেন শিওন। 

নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চিত থাকার পরও সন্তানের দিকে তাকিয়ে এক ছাদের নিচে থাকা শুরু করেন শিওন ও লোন। বাবা-মায়ের সঙ্গে রায়ান

সন্তানের ছোটোখাটো মুহূর্তগুলো রেকর্ড করে রাখা অনেক বাবা-মায়েরই শখ। এরকম শখের বসেই রায়ানের ভিডিও করা শুরু করেছিলেন তার মা। 
তিন বছর বয়সী রায়ান একটা খেলনার স্টোরের ফ্লোরে  গড়াগড়ি খাচ্ছে, সে অবস্থাতেই তার মা তাকে জিজ্ঞেস করে ‘আজকে কী নিবে তুমি? এ সপ্তাহের খেলনা কোনটা হবে?” প্রশ্ন শুনে রায়ান উঠে দাঁড়ায়, শিশুসুলভ সারল্যের সঙ্গে বলে, ‘লেগো চু চু ট্রেন’। 

এটি ছিল রায়ানের প্রথম ভিডিও। ইউটিউবে থাকা লাখ লাখ এই বয়সী শিশুর ভিডিও থেকে এই ভিডিওটি কোনোভাবেই আলাদা নয়। রায়ানের মা, লোনও এ থেকে বাড়তি কিছু আশা করেননি। তার দাবি, রায়ানের নানা-নানীকে দেখাতেই শুরু করেছিলেন ভিডিও করা। 

কিন্তু ‘এ সপ্তাহের খেলনা’- বাক্যটি শুনে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, একদম পরিকল্পনাহীন শুরু ছিল না এটা। লোন চাচ্ছিলেন, প্রতি সপ্তাহে রায়ানকে একটি খেলনা কিনে দিতে। সেই খেলনা পাওয়ার খুশিতে রায়ানের উচ্ছ্বাস বা খেলনা সম্বন্ধে ছোট্ট রায়ানের অভিমত, এগুলো রেকর্ড করতে চান তিনি। 

রায়ানের বাবা, শিওনও রাজি হন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ইউটিউবের সঙ্গে পরিচিত হওয়া শিওনের এই ওয়েবসাইটের ধরন ও অ্যালগরিদম সম্বন্ধে ভালো ধারণা ছিল। 

তবে প্রথম ভিডিও প্রকাশের পরই কিন্তু জনপ্রিয় হয়ে যায়নি রায়ান। বরং তার প্রথম কয়েকটি ভিডিওর তেমন কোনো দর্শকই ছিল না। তবে কয়েকটি ভিডিও করার পর রায়ানের মা একটি ট্রেন্ড অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নেন। 

সেসময় শিশুদের ভিডিওতে একটি জনপ্রিয় ট্রেন্ড চলছিল খেলনাভর্তি ডিম্বাকৃতির একটি বড়সড় বেলুনকে ঘিরে। সেই ট্রেন্ড অনুসরণ করে বানানো লোনের ভিডিওটি হয় এমন- 

রায়ানকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলেন লোন। ভান করা ঘুম থেকে জেগে ওঠে বিশালাকৃতির ডিমের মতো বেলুনের দিকে চোখ যায় রায়ানের। চোখে বিস্ময় নিয়েই সেই বেলুনে আঘাত করা শুরু করে রায়ান। তারপর ভেতর থেকে একের পর এক খেলনা বের করে আনতে শুরু করে। 

এই ভিডিও দিয়ে ইউটিউববাসীর নজর কারে রায়ান। বর্তমানে ভিডিওটির ভিউ একশ কোটিরও বেশি। 

রায়ানের উত্থান ও খ্যাতির পিছনে তার সময়ের অবদান অনেক। ২০১৫ সালে পুরো বিশ্বেই প্রযুক্তিগত পরিবর্তন দেখা দিতে শুরু করে। ট্যাবলেট ও ল্যাপটপের দাম কমায় প্রথম বিশ্বে ঘরে ঘরে এসব ডিভাইস দেখা যেতে শুরু করে। বাবা-মায়েরাও দেখতে পান, সন্তানকে ব্যস্ত রাখার জন্য সবচেয়ে সহজতম উপায় ইউটিউব ভিডিওই। 

সেবছরই শিশুদের ভিডিওর জন্য ‘ইউটিউব কিডস’ নামে একটি আলাদা অ্যাপ বের করে ইউটিউব। 

২০১৫ সাল পরবর্তী সময়কে এমনিতেও ডিজিটাল অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি পর্ব হিসেবে দেখা হয়। এ সময়ে ডিজিটাল বিজ্ঞাপন জনপ্রিয়তা পাওয়া শুরু করে। বিজ্ঞাপনদাতারা কন্টেন্ট বুঝে নির্দিষ্ট দর্শকের কাছে নির্দিষ্ট সময়ে তাদের বিজ্ঞাপন পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ পান। এছাড়া, তারা খেয়াল করেন, নামী সেলেব্রিটিদের চেয়ে এসব ডিজিটাল প্লাটফর্মে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মাধ্যমে তারা আরও ফলপ্রসূভাবে বিজ্ঞাপন পৌঁছে দিতে পারছেন। যেমন, ইউটিউবের ফোন রিভিউয়ারদের মাধ্যমে ফোনের বিজ্ঞাপন, কাজীর মতো শিশু সেলেব্রিটিদের মাধ্যমে শিশুদের খেলনার বিজ্ঞাপন দেওয়াটা সহজতর ও কার্যকর।  

ভাগ্যের হাতে ভাইরাল হওয়া 

ভাইরাল হওয়ার কোনো নির্দিষ্ট প্যাটার্ন বা নমুনা নেই। হতে পারে একজন টিনেজার কোনো নির্দিষ্ট ভঙ্গিতে বসে ছবি আপলোড করেছে। এবং সেই ছবি রাতের মধ্যে ইন্সটাগ্রামে এতোটাই হিড়িক ফেলে দেয় যে এই বয়সী অন্যান্য নেটিজেনরাও একই ভঙ্গিতে বসে ছবি আপলোড করা শুরু করে। এবং কিছু বুঝার আগেই সেই টিনেজার ১০ লাখ ফলোয়ার পেয়ে বসে।  

ডিমের ভিডিওটি দিয়ে প্রথম ভাইরাল হয় রায়ান। এরফলে ইউটিউবের কাছ থেকে প্রথমবারের মতো ১৫০ ডলারের একটি চেক পায় তার পরিবার। সেই শুরু। এরপর কাজী পরিবারের কাছে ইউটিউবের টাকা আসা আর বন্ধ হয়নি। 

এক বছরের মধ্যে ইউটিউবের সবচেয়ে জনপ্রিয় চ্যানেলগুলোর একটি হয়ে উঠে ‘রায়ানস টয়সরিভিউ’ (রায়ানস ওয়ার্ল্ড-এর পূর্বরূপ)।  ২০১৬ সালে রায়ানের বাবা-মা দুজনই নিজেদের চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরো সময় রায়ানের পিছনে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।  

শিওন ছিলেন একজন স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার। ৫ বছর বয়সী রায়ানের উপর বেশি চাপ পড়ে গেলে যে সে তা বহন করতে পারবে না, সেটি বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। তাই প্রোডাকশন টিমকে আরও শক্তিশালী করে কাজ ভাগ করে দিতে শুরু করেন তিনি। অ্যানিমেটর এনে রায়ানের ব্যক্তিত্বের উপর ভিত্তি করে চরিত্র তৈরি করা শুরু করেন। শিওন এবং লোনও ভিডিওগুলোতে উপস্থিত হতে শুরু করেন। দুই ছোটবোনের সঙ্গে রায়ান

রায়ান জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে যাওয়ার পর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন তারা। সেসময় শিশুদের সিংহভাগ ভিডিওই তৈরি হতো পরিচিত ব্র্যান্ডগুলোকে কেন্দ্র করে। ইউটিউবে ‘টমাস দ্য ট্রেন’ লিখে সার্চ দিলে আপনি অসংখ্য ভিডিও খুঁজে পাবেন। এই দৃশ্যমানতার জন্যই প্রায় ইউটিউবারই তাদের ভিডিওর শিরোনামে এসব ব্র্যান্ডের নাম রাখে। কিন্তু লোন ও শিওন সিদ্ধান্ত নেন, এই পথে হাঁটবেন না তারা। বরং রায়ানের নিজস্ব ব্র্যান্ড গড়ে তুলবেন। 

সেই লক্ষে একাধিক ইউটিউব চ্যানেল খোলেন তারা। একটি চ্যানেল হয়তো বাচ্চাদের বিজ্ঞান শেখানোর চ্যানেল, একটি হয়তো নতুন খেলনার চ্যানেল। সবগুলো চ্যানেলেরই আলাদা নিজস্বতা রাখার চেষ্টা করেন তারা। এবং বিভিন্ন চ্যানেলে ভাগ হয়ে যাওয়ায় রায়ানের উপর চাপও কমে যায় কিছুটা। 

প্রতিদিন একাধিক ভিডিও বের করা এসব চ্যানেলের প্রায় সব ভিডিওতেই উপস্থিত হয় রায়ান। তবে খুব কম ভিডিওতেই কয়েক সেকেন্ডের বেশি দেখা যায় তাকে। কোনো এক ভিডিওতে হয়তো দেখবেন, শুরুতে রায়ান বলছে, “হাই, আমি রায়ান। এখন সুনামি কীভাবে হয় তা তোমাদেরকে দেখাবে আমার বন্ধু…”

পুরো ভিডিওতে রায়ানের অংশ এতোটুকুই। 

c

ডিজনি নির্বাহীর সঙ্গে চুক্তি 

২০১৭ সালে ডিজনি স্টুডিওর সাবেক নির্বাহী ক্রিস উইলিয়ামসের নজরে পড়ে রায়ান। উইলিয়ামস খেয়াল করেন, টিভির রেটিং এবং দর্শক দিন দিন কমছে। আর বাচ্চাদের এবং পারিবারিক ভিডিওগুলোর দর্শক বাড়ছে ইউটিউবে। 

ডিজনিতে কাজ করা উইলিয়ামস ফ্র্যাঞ্চাইজের গুরুত্ব সম্বন্ধেও জানতেন। টাইম ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “ইউটিউবে যেসব সেলেব্রিটি, চরিত্র এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আছে তা পুরো ডিজনি চ্যানেল নেটওয়ার্কের চেয়েও বেশি দর্শক আকর্ষণ করে। কিন্তু এদেরকে নিয়ে কেন কোনো চিন্তা করছি না আমরা?” 

২০১৭ সালে পকেটওয়াচ নামের একটি কোম্পানি খুলেন তিনি, যার কাজ ইউটিউব তারকাদের চুক্তিবদ্ধ করা। ততদিনে ‘সানলাইট এন্টারটেইনমেন্ট’ নামের নিজস্ব স্টুডিও খোলে ফেলা রায়ানের পরিবার হয় পকেটওয়াচের একদম প্রথমদিকের অংশীদার। 

পকেটওয়াচের সঙ্গে যোগ দেওয়ার পর ওয়ালমার্ট, অ্যামাজন ও স্কেচার্সের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে স্পন্সরশিপ চুক্তি পেতে শুরু করে রায়ান।  

২০১৯ সালে ভোক্তা অধিকার সংঘ ‘ট্রুথ ইন অ্যাডভারটাইজিং’ মামলা করে বসে রায়ানের পরিবারের বিরুদ্ধে। তাদের অভিযোগ, বিজ্ঞাপনদাতাদের পরিচয় ঠিকভাবে প্রকাশ না করে লক্ষ লক্ষ অল্পবয়সী শিশুদের সঙ্গে প্রতারণা করছে রায়ানের পরিবার। এই অভিযোগ অস্বীকার করে কাজী পরিবার। তাদের দাবি, বিজ্ঞাপনের ব্যাপারে সব প্ল্যাটফর্মের সব শর্তাবলীই কঠোরভাবে অনুসরণ করেন তারা।

‘রায়ানস ওয়ার্ল্ড’-এর সঙ্গে এখনও খেলনা ও স্ট্রিমিং নেটওয়ার্কগুলোর একাধিক স্পন্সরশিপ ও লাইসেন্সিং চুক্তি রয়েছে। এসব চুক্তি থেকে বিশাল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে কাজী পরিবার। 

বর্তমানে সানলাইট এন্টারটেইনমেন্টে ৩০ জনেরও বেশি কর্মচারী রয়েছে। ভিউ সংখ্যায় তাদের ফ্র্যাঞ্চাইজ, রায়ানস ওয়ার্ল্ড ইউটিউবের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ১০ নেটওয়ার্কের একটি। বর্তমানে এর ইউটিউব ভিউ সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার কোটি। 

এই সংখ্যাটি এতোই বিশাল যে, রায়ানের প্রতিটি ভিডিও যদি মাত্র ৩০ সেকেন্ড করেও দেখা হয়, তাহলে ১০ বছর বয়সী রায়ান যেই কয় মিনিট এই পৃথিবীর আলো দেখেছে, তারচেয়ে সাড়ে চার হাজার গুণ বেশিবার তাকে দেখেছে মানুষ। 

Source: tbsnews

Continue Reading
Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *